সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

একটি আন স্মার্ট মেয়ে নাদিয়ার সফলতার গল্প

এক মনে ডায়েরিটা লিখে চলেছে নাদিয়া:-

আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। তাই দীর্ঘ সময় পর আবার আমি ডায়েরি লিখতে বসেছি। ডায়েরির পাতায় ভিজে যাচ্ছে চোখের জ্বলে। এটা কষ্টের কান্না নয়, আনন্দের কান্না। আমি পৃথিবীর অন্যতম একটা সুখী মেয়ে। কিন্তু চোখের জল যেন বাধা মানছে না।

অশ্রুসিক্ত নয়নে ঝাপসা হয়ে উঠছে আমার অতীত।
তখন আমি দশম শ্রেণীতে উঠেছি মাত্র। রোজ রোজ হেটে স্কুলে যেতাম আর যাবার পথে একটি বাসার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম। সেই বাড়ির জানালায় আমার প্রিয় মানুষ টার মুখ মাঝে মাঝে উকি দিত। এক পলক দেখার মাঝেই ইনফিনিটি ভালো লাগা কাজ করত।

অনেকদিন ধরেই ভাল লাগত জনি নামের এই ছেলেটিকে। কিন্তু কখনো আমি কারও নিকট প্রকাশ করিনি।

একটি আন স্মার্ট মেয়ে নাদিয়ার সফলতার গল্প



জনি ভাইয়া আমার দিকে একটু তাকালেই আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠতাম। প্রতিনিয়ত আমার ভেতর টা ভালবাসা নামক এই যন্ত্রণার দহনে দগ্ধ হচ্ছিল।

একদিন আমি লাজ লজ্জা ভুলে ভাইয়াকে বলেই ফেললাম।

- ভাইয়া, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই,
- হ্যা বলো,
- আমি আপনাকে ভালবাসি।

তখন জনি ভাইয়া অনেক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আর আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিলাম।

আর ভাইয়া হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছিল কথা টা। তখন আমি ভীষণ রেগে বলেছিলাম, আমি কি ফাজলামি করছি মনে হচ্ছে? আমি সত্যিই আপনাকে ভীষণ পছন্দ করি।

খুব করে চেষ্টা করলাম নিজের অনুভুতি টা বোঝাতে। কিন্তু আমার আবেগ মিশ্রিত শত কথাও যেন জনি ভাইয়ার মনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না।

ওদিকে আমার পাগলামি ক্রমশ ই বেড়ে যাচ্ছিল। আমার এমন পাগলামি দেখে ভাইয়া বলেছিল, "তুমি আমাকে কিছুদিন সময় দাও। আমি ভেবে চিন্তে জানাবো।"

আমি আর কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারিনি। কিছুদিন অজানা এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সারাক্ষণ জনি ভাইয়ার কথা ভাবতাম। বিশ্বাস ছিল ভাইয়া নিশ্চয়ই আমার ভালবাসাকে গ্রহণ করবে। আমি নামাজের পর নফল নামাজ পড়ে ভাইয়ার জন্য দুয়া করতাম যেন সে সবসময় সুস্থ থাকে।

অবশেষে ভাইয়ার নির্দিষ্ট সময় পর তার মুখোমুখি হলাম।

আমার বুকের ভিতর টা দুরুদুরু কাঁপছিল। ভয়ে ভয়ে তার সামনে গিয়েছিলাম ভীষণ প্রত্যাশা নিয়ে।

কিন্তু ভাইয়া বলেছিল ,"তুমি অনেক ভালো একটি মেয়ে। শুনেছি অনেক মেধাবী ও। কিন্তু নাদিয়া, তুমি অনেক আন স্মার্ট আর গাইয়া টাইপের।আমার সাথে তোমার খাপ খায় না।"
ভাইয়ার মুখে এই ধরনের কথা শুনতে হবে এটা কখনো ভাবিনি। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। তবুও কান্না চেপে বলেছিলাম, আমি আপনাকে খুব ভালবাসি। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই আমায় গড়ে তুলবো।

আমার এই কথাটি শুনে ভাইয়া হেসে বলেছিল, তুমি ভদ্র মেয়ে। ভালো ছাত্রী, এইসব প্রেমের চিন্তা বাদ দিয়ে লেখাপড়া করো মন দিয়ে।

প্রচুর কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। তবুও আমি ভাইয়াকে আপন করে নেওয়ার অনেক চেষ্টাই করেছিলাম। কিন্তু সবসময় ই সে আমাকে বিভিন্নভাবে অপমান করতো। তারপর ও আমার পাগলামি থামেনি।

একদিন ভাইয়া রেগে বলেছিল, তুমি একটা বেহায়া মেয়ে। বলছি তো ভালবাসি না। তবুও কেন পিছে পড়ে আছো। আসলে তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন।

ভাইয়ার এই কথাগুলি সেবার আত্মসম্মানে লেগেছিল খুব। আর কখনো তার সামনে যাইনি।
গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম। এসএসসি তে আমাদের থানায় সেরা রেজাল্ট করলাম আমি।

এই সফলতা অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। আমি শুধু লেখাপড়াই করতাম। আড়াল করে নিয়েছিলাম নিজেকে। সারাক্ষণ লেখাপড়ায় ডুবে থাকতাম।

মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখতাম আর ভাবতাম, আমি এত আন স্মার্ট যে কারও ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।আমি দেখতে শ্যামলা, আমার জামা কাপড় আর সবার মত শর্ট কাট নয়।আমি স্টাইল করে চলতে পারিনা। কিন্তু এইগুলাই কি ভালবাসা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট? আমি তাকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করলাম, অথচ আমার ভালবাসার কোনো দাম নেই! আজকাল গেট আপ টাই সব।

এসব ভেবে ভেবে আমি খুব কাঁদতাম। কারও সামনে খুব কম যেতাম। কিন্তু লেখাপড়া নিয়ে থাকতাম সারাক্ষণ।

এইচ.এস.সি তেও অনেক ভালো ফলাফল করে ফেললাম। আমার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পত্রিকায় আমার রেজাল্ট নিয়ে লেখা হলো। লেখাটি পড়ে পত্রিকা বুকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলাম।

বাবা মা খুশি হয়ে আমায় কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিলেন। ক্লাস করা ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাইরে বের হতাম না। আর আমার কোনো বন্ধু ছিল না। অনেকেই তো বন্ধুত্ব করতে চাইত। তারা নিজে থেকে আমার সাথে মিশত। কিন্তু আমার বরাবরই আমার একটা কথাই মনে হত,"তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন " এই কথা টি মনে হলেই আর কারও সাথে মিশতে সাহস করতাম না। আমি একদিন প্রমাণ করে দিবো, আমি মানসিক সমস্যাগ্রস্ত নই। আর সেদিন আমি বন্ধুত্ব করবো সবার সাথে।

আমি রুম থেকে বের হতাম না। সারাক্ষণ শুধু বই আর বই।ফলস্বরুপ, প্রথম পরীক্ষাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলাম।

ভার্সিটিতে ভর্তির পরও সহজে কারও সাথে মিশতে পারতাম না।একাকীত্বের সাথে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

নিজের চেহারা, ফিটনেস, রূপচর্চা, এইসব নিয়ে কখনোই ভাবতাম না। কিন্তু ভার্সিটি তে আসা যাওয়া করতে করতে কিভাবে যেন আমার মানসিকতা, সৌন্দর্য সবকিছুই চেঞ্জ হয়ে যেতে লাগল। নিজেকে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যেতাম।

সবকিছু মিলিয়ে আমার ভালোই দিন যাচ্ছিল। আর লেখাপড়া করাটা অভ্যাসে পরিণত হওয়ার কারনে সর্বক্ষণ লেখাপড়াই করতাম।

অনেকেই আমার পাশে থাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতো। কিন্তু আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতাম। আমার জীবনে কোনো স্পেশাল ভালবাসার প্রয়োজন নেই এখন। বাবা মায়ের ভালবাসা আছে, তাতেই আমার স্বর্গ।ছোট এই জীবন টা লেখাপড়া করেই কাটিয়ে দেয়া যায়।

লেখাপড়াই একমাত্র প্রেম ও সাধনা হয়ে উঠেছিল। প্রেমিক হয়ত ছেরে চলে যায়, কিন্তু আমার লেখাপড়া কখনো আমায় ছেড়ে চলে যাবে না। সব ভালবাসা বইকেই দিয়ে দিয়েছি।
আজ আমার লাইফের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আমি স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় যাচ্ছি লেখাপড়া করতে। আমি সুখী, আমি সফল, আমি আমার গর্ব।

ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখল নাদিয়া। আগামীকাল এটা সাংবাদিক দের হাতে চলে যাবে। তারা নাদিয়ার সফলতার ইতিহাস জানতে চেয়েছিল। নাদিয়া এই দুই পাতা লিখে ডায়েরি রেখে দিলো। চোখের পানিতে ডায়েরির পাতা এমন ভাবে ভিজে যাচ্ছে যে আর কিছু লিখাই যাচ্ছে না। এই কাহিনী টা পত্রিকায় বের হলেই দেশের হাজারো মেয়ে জানবে নাদিয়ার সফলতার কথা।সকলেই জানবে নাদিয়া জনি নামের কাউকে পাগলের মত ভালবাসত কিন্তু ছেলেটা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে অপমান করেছিল।

ভাবতে ভাবতে নাদিয়া বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসলো। সকলেই জিজ্ঞেস করছে নাদিয়া কবে বিদেশে যাচ্ছে, কি কি সুবিধা পাচ্ছে ইত্যাদি। হথাৎ জনি ভাইয়ার সামনে পড়ে গেল নাদিয়া। জনি মাথা নিচু করে চলে গেল।আজ সে বাজারে একটা ইলেকট্রনিক্স এর দোকানদার। আর যে মেয়েটাকে সে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে গালি দিয়েছিল সে মেয়েটা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। নাদিয়ার সামনে মাথা উচু করে চলার মত যোগ্যতা টা এখন জনির নেই।

নাদিয়া পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আর মনে মনে বলল, বাহ্যিক সৌন্দর্য মুখ্য নয়, প্রত্যেকেরই অন্তুর্নিহিত শক্তি থাকে। একটি মানুষ চেষ্টা করলেই নিজের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাকে বড় শক্তিতে পরিণত করতে পারে। আমি পেরেছি, আমার জীবনে আর কারও প্রয়োজন নেই। আমার সেদিনের দুর্বলতাই আজ আমার শক্তি।

লেখা: মিশু মনি, সংগ্রহে: মিম (আংশিক পরিবর্তিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন