শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গল্পঃ বৃষ্টির সময় ডেটিং ও কিছু পুরানো স্মৃতি

কফি হাউসে বসে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর বাইরে বৃষ্টি দেখছি। কফি হাউসের স্বচ্ছ কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরের যান চলাচল দেখা যাচ্ছে। যখন বিদ্যুৎ চমকে উঠছে , তখন কাঁচের উপর জমা পানির বিন্দুগুলি হীরের টুকরোর মতো ঝলঝল করে উঠছে। আমার মুখোমুখি টেবিলের ওপাশে একজন আশ্চর্য রকমের রূপবতী মেয়ে বসে রয়েছে। আশেপাশের মানুষগুলি বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। তাই অস্বস্তি দূর করার জন্য আমি বাইরের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আজকেই আমাদের প্রথম দেখা। আমাদের পরিচয় ফেসবুকেই।

তখন ভোর রাত প্রায় ৪টা। ল্যাপটপ শাটডাউন করে টেবিল গুছিয়ে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় ম্যাসেঞ্জারের টুং শব্দ। ভোর রাতে ম্যাসেঞ্জারের নোটিফিকেশন এর শব্দে ভ্রু কুঁচকে মোবাইলটি হাতে নিয়ে দেখি ম্যাসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে। ম্যসেজ ওপেন করতেই বিশাল বড় একটি এসএমএস, 

"মাঝরাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে এসএমএস না দিয়েও পারলাম না ! আপনার সব লিখাই আমি পড়ি। শুধু পড়ি বললে ভুল হবে খুব মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করে করে পড়ি। আপনি কি জানেন আপনার লিখাগুলি যে সুসাইডাল? আপনার কিছু লিখা আছে যা একটি সুস্থ মানুষকে ডিপ্রেশনের সেকেন্ড স্টেজে নিয়ে যেতে যথেষ্ট! এতো গুছানো শব্দে মানুষকে ডিপ্রেশনে ফেলতে আপনার একটুও মন খারাপ লাগে না? ..........................................।"(সাথে আমার কিছু পোস্টের স্কিনশর্ট দেয়া)

গল্পঃ বৃষ্টির সময় ডেটিং ও কিছু পুরানো স্মৃতি


এভাবেই আমাদের পরিচয়। যতবার লিখা পোস্ট করতাম, ইনবক্সে এসে এর ব্যাখ্যা চাইতো, ঘোর বিরোধিতা করতো আমার লিখার,জানতে চাইতো এই লিখার পেছনের ঘটনা। এভাবেই চলতে থাকে কথাবার্তা। মেয়েটি পাগলাটে স্বভাবের মনে হতে লাগল আমার কাছে, বেশ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার ! বেশি একটি সিরিয়াসলি নিতাম না ওর কথাবার্তাকে। এর মাঝে কয়েকবার দেখা করার কথা বলে, বরাবরই না করে গিয়েছিলাম। 

বাইরে বৃষ্টি আরো বেড়েছে। বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালাম। দেখতে কফি হাউসের আলোয় অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে। মেকআপ নামক কৃত্রিমতা একদমই পছন্দ করি না আমি, এই প্রথম কাউকে দেখে মনে হলো, ডিসেন্ট মেকআপ পরিবেশের সাথে কিছু মেয়ের সৌন্দর্য্য ভয়ংকর রকমের বাড়িয়ে দেয়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে এসব ভাবনা দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্যে আবারও আমি বাইরে তাকালাম। তখনই সে বলে উঠে," আপনি আমার সাথে মাইন্ড গেইম খেলার চেষ্টা করছেন? যদি সত্যিই তা করে থাকেন তাহলে আপনি ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। আপনাকে আমি আপনার থেকেও অনেক বেশি চিনি। আপনি আমাকে জোর করে ইগনোর করার চেষ্টা করছেন। এখানে আসার পর থেকে ঠিকমতো তাকাচ্ছেনও না আমার দিকে।”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটি হাঁসি দিলাম ! বললাম," মাইন্ড গেইম তো তুমিই আমার সাথে খেলছো। যখন বুঝতে পারলে আমি দেখা করতে ইচ্ছুক না, তখন আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে। যথারীতি হারিয়েও দিলে, যার ফলে আমি এখন তোমার সামনে বসে আছি! আমার মনে হয় শুরুতেও তুমি তাই করেছো। ভোর রাতে এভাবেই এসএমএস দিয়ে কিছুটা এ্যাটেনশান সিক করতে চেয়েছো, এবং তুমি সফলও ! তুমি জানো আমি মেকআপ পছন্দ করি না তাই এমনভাবে সাজঁলে যে,"মেকআপ মানুষ খাই" আমার এই ধারণা আজ ভুল প্রমাণ করাতে চাচ্ছো । হ্যাঁ,আসলেই তোমাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। তুমি এটিও প্রমাণ করতে চেষ্টা করছো,’এক নারীতে আসক্ত হওয়া পুরুষ, আরেক নারীতে মুভ অন করতে পারে।' " 

অমার কথা শুনে মনে হলো ও কিছুটা কষ্ট পেয়েছে। অমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চুপচাপ বৃষ্টি দেখতে শুরু করলো। নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ সামনে ফিরে চোখে চোখ রেখে স্থির দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলো," আচ্ছা আমি কি যথেষ্ট না আপনার জন্য? আপনি তিন বছর আগে ছেড়ে যাওয়া মানুষটিকে এখনও আঁকড়ে ধরে আছেন ! আমি কী আপনার প্রাক্তণ থেকে কম সুন্দরী? " 

এবার আমি তার সাথে মাইন্ড গেইম খেললাম ! তার প্রশ্নের জবাব পাল্টা প্রশ্নে দিলাম," তুমি বলেছিলে আমাকে ভালো করেই চিনো। যদি কথাটি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আশা করি তুমি তোমার উত্তরটি পেয়ে গিয়েছো। তোমার যদি মনে হয় আমি তোমার জন্য পারফেক্ট কেউ ,এটািতোমার ভুল ধারণা। আমি ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা এক ধূলিকণা মাত্র কিংবা বলতে পারো আমি অতীতে নিলামে বিক্রি হয়ে যাওয়া কোনো এক দ্রব্য যার ক্রেতা ৩ বছর আগেই একে ফেলে দিয়েছে,যা দ্বিতীয়বার বিক্রয়যোগ্য নয়!

সে হার না মানাদের দলের। প্রত্যুত্তর দেয়," আপনি বহুদিন আগে বিক্রি হয়ে যাওয়া এক দামী এ্যান্টিক পিস। আপনি সেই সব মানুষদের দলে,যারা ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুল তুলে দাঁড়িয়ে আছেন উপকুলের আশায়,যার নাবিকের প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ-ক্ষোভ কিংবা ঘৃণা নেই! আপনি ঘুড়িদের কাটাকাটি খেলায় কেঁটে পড়া সেই ঘুড়ি যার এখন একটি নাঁটাই এর প্রয়োজন। " 

এর জবাবে আমি কি বলবো, তা অমার জানা নেই। তাই চুপ করে রইলাম। নাহ, আমাকে এবার উঠতে হবে, সিচুয়েশান আমার আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। ও আমার  দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। আমি চুপচাপ উঠে কাউন্টারে গেলাম, বিলটি পে করে স্টাফ থেকে পেন এবং পেপার নিয়ে লিখতে শুরু করলাম সেখানে দাঁড়িয়েই। কফি হাউসের কর্নারের টেবিলটায় বসে ও কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ছোট করে একটি চিরকুট লিখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। যে কথাগুলি ওর সামনে বলার আর ধৈর্য্য এবং সাহস কোনটিই পাচ্ছিলাম না।

" তুমি আমার দেখা সবচেয়ে রূপবতী এবং খুব সহজেই ভালো লেগে যাওয়া মানুষদের মধ্যে একজন। তোমাকে আমার এই বিষণ্ণতার জগতের সঙ্গী বানিয়ে তোমাকে অসুখী করতে চাই না। তোমার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তোমার সঠিক কদর করতে জানবে । আমি দুঃখিত !"  

স্টাফকে দিয়ে চিরকুটটি পাঠিয়ে দিলাম। বাইরে বৃষ্টির গতি অনেকটা কমেছে। আমাকে এখন বেড়িয়ে পড়তে হবে। বের হওয়ার সময় ওর দিকে তাকালাম। চিরকুট হাতে ভেঁজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম, কিছু না বলেই। এই আবহাওয়ায় একটি সুন্দরী বসে বসে চোখের পানি ফেলছে, যা দেখার মতো সহ্যশক্তি আমার নেই। কাউকে কাঁদানোর অধিকারও আমাদের নেই, তারপরও আমরা কাঁদিয়ে ফেলি! 

রাস্তা দিয়ে হাঁটছি বৃষ্টির ফোঁটা গাঁয়ে মাখছি আর মন থেকে এক রূপবতী মেয়েকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে । পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে একে একে সেই ভোর রাতের অপরিচিত আইডিটার চ্যাট হিস্টরি ডিলেট করছি। একাউন্টটি ব্লকলিস্টে ফেলে দিলাম। 

তিন বছর আগে প্রাক্তনের বলা একটি কথা মনে পড়ে গেল,  " যত যেই আসুক তোমার জীবনে , যত মেয়ের কাছেই যাও, দিনশেষে তুমি শুধু আমার কাছেই ফিরে আসতে চাইবেই, আমার কথা তোমার মনে পড়বেই। " সেদিনের হাসতে হাসতে বলা কথাগুলি হারে হারে টের পাই এখন !

বয় Aman Bhuiyan

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন