"তুই ওর সাথে এমন হেসে হেসে কথা বলছিলে কেনো, নাইমা? আমি ছাড়া তুই আর কারো সাথে কথা কইবি না।"
নাইমা তখন স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
"কেনো? আমার কী কথা বলা নিষেধ?""তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড। তুই ওর সাথে এত কথা বলবি কেনো?"
নাইমা ওর দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
"তোকে সিরিয়াসলি একটি কথা আস্ক করব, রুপা?"
"কী কথা?"
"তোর ভেতর কী ওই ধরণের কোনো সমস্যা আছে?"
রুপা ঠিক বুঝতে না পেরে বলল,
"কী সমস্যা?"
"একটি মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়েদের প্রতি শারীরিক ভাবে এট্রাক্টেড হওয়া এই ধরণের কিছু।"
কথাটি শুনে রুপা ছি ছি করে উঠল। রেগে বলল,
"ওই, এটা কী রকম কথা বলছিস! তোর সাথে কী আমি কখনো.... ছি ছি।
এসব মুখে আনতেও লজ্জা করছে। আর তুই কিনা এসব ভাবছিস!"
এবার নাইমাও কিছুটা রেগে যেয়ে বলল,
"তাহলে তুই কেনো আমার উপর এতটা অধিকার দেখাস? কারোর সাথে কথা বললেই এমন জেলাস ফিল করিস। তোর এরকম কিছু কিছু কাজের জন্য আমার সন্দেহ হয় তোর উপর। আর তোর কারনে আমার অন্য কারোর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। শোন, তোর সাথে আমার আর একটুও বন্ধুত্ব রাখা সম্ভব না। তুই তোর মত কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে নিস। তোর কারনে আমাকেও অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়।"
একটানা কথাগুলো বলে চলে গেল নাইমা। রুপা চুপ করেই তার কথা গুলো শুনছিল। নাইমার মুখে কিছু আটকায় না। যা মুখে আসে বলে দেয়।
নাইমা চলে যাওয়ার পরেও রুপা অনেক্ষণ সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। স্কুল, কলেজ জীবনে তার কখনো কারোর সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠেনি।
ভার্সিটিতে উঠে নাইমার সাথে তার বন্ধুত্ব। এক পর্যায়ে গিয়ে বেস্ট ফ্রেন্ডশিপও হয়ে যায় তাদের। আর রুপার মনেও চিন্তা ঢুকে যায় নাইমা হয়ত তার সাথে বন্ধুত্ব রাখবে না। তার একদম চুপচাপ, রসকষহীন স্বভাবের জন্য কেউ তার সাথে আড্ডা জমাতে পারে না। কোনো পার্টি, বেড়াতে যাওয়া কোথাও তার উপস্থিতি থাকে না।
একমাত্র নাইমা তার সাথে নিজে থেকে বন্ধুত্ব করতে আসে আর তার সাথে আড্ডাও জমায়। সেও মন খুলে কথা বলতে শুরু করে।
তার মনের ভেতরে একটি ভয় থাকে নাইমা হয়ত তার সাথে গিয়ে একটা সময় বন্ধুত্ব রাখবে না। সেজন্য নাইমা অন্য কারোর সাথে কথা বললে, কোথাও বেশি আড্ডা দিলে সে সেটা সহ্য করতে পারে না। তাকে নিয়ে আসে। যার ফলস্বরূপ পুরো ক্লাসের মধ্যে তাদের নিয়ে সবাই হাসাহাসিও করে। সবাই বুঝতে পারে রুপা ইচ্ছে করে নাইমাকে কারোর সাথে মিশতে দেয় না। আর এই বিষয়টা একটু বিধগুটে লাগে সবার সাথে।
রুপাকে এক জায়গাতে এভাবে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিশা এসে জিজ্ঞেস করল,
"তুমি বাসায় যাবে না? নাইমা তো বাসায় চলে গিয়েছে।"
"নাইমা আমাকে রেখে চলে গেল?"
"হ্যাঁ, মাত্রই বের হলো।"
রুপার কেন যেন খুব কষ্ট হতে লাগল। তার মনে হচ্ছে সে হয়ত তার মনের কথা বলার একমাত্র সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলেছে। নাইমা ওকে রেখে কিভাবে চলে যেতে পারল!
রুপা চলে আসতে যাবে তখন তিশা জিজ্ঞেস করল,
"তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করব?"
"হ্যাঁ, করো।"
"আসলে আমি তো এই ডিপার্টমেন্টে নতুন। তোমাকে আর নাইমাকে নিয়ে একটি কথা শুনেছি।"
"কী কথা?"
"তুমি নাকি নাইমাকে পছন্দ করো?"
রুপা স্বাভাবিকভাবে বলল,
"হ্যাঁ, ও আমার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড পছন্দ তো করবোই।"
তিশা তখন একটু ইতস্তত ভাবে বলল,
"না মানে ছেলে মেয়েদের সম্পর্ক যেমন হয়, প্রেমের সম্পর্ক।"
কথাটা শুনে রুপা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তিশার গালে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে বসল।
তারপর রুপা সেখান থেকে চলে গেল।
বাসায় ফিরে সে কয়েকবার নাইমাকে কল দিল। নাইমা কল ধরছে না। বারবার কেটে দিচ্ছে। একসময় বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করল।
"কী হয়েছে বল।"
"তুই আমাকে রেখে চলে আসলি কেন ভার্সিটি থেকে?"
"তো কী করতাম? তোকে কোলে করে বাসায় নিয়ে আসতাম?"
"এভাবে কেন বলছিস? আমি কোনো ভুল করে থাকলে মাফ করে দে, প্লিজ।"
"এই এসব ঢং করবি না তো। আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না। আর ক্লাসেও আমার সঙ্গে ঘেষবি না একদম। তোর এই বাজে অভ্যাসের জন্য তোর কেউ বন্ধু হয় না।"
এই বলে কল কেটে দিল নাইমা। কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে ফোনটা আছড়ে ফেলল দেয়ালে।
আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
"তুই আমার একমাত্র বন্ধু, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড... তুই অন্য কারোর বন্ধু হবি না।"
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলেন রুপার মা নাদিয়া আলী বেগম। মেয়ের সাথে এতদিন কঠোর রূপেই ধরা দিতেন তিনি। তার মতে একটু আধটু শাসন না করলে সন্তান বিগড়ে যায়। তবে তার সেই একটু আধটু শাসনটা অনেক সময়ই তীব্র আকার ধারণ করত। যেটা রুপাকে তার থেকে অনেকটাই দূরে নিয়ে গেছে।
এসে দাঁড়ালেন মেয়ের সামনে। তার মাথায় হাত রেখে বললেন,
"তুমি আমাকে তোমার বন্ধু বানাবে? বেস্ট ফ্রেন্ড? তোমার সব মনের কথা আমাকে বলবে। সারাদিন কী হয় না হয় আমার কাছে বলবে।"
রুপা তখন উঠে দাঁড়ালো। এরপর বলল,
"তুই আমি বাদে আর কারোর বন্ধু হবি না তো? বেস্ট ফ্রেন্ডকে কিন্তু তুই বলতে হয়। এজন্য বললাম।"
মেয়ের মুখে তুই শুনে কিছুটা হতবাক হয়ে যান নাদিয়া। এরপর হাসতে হাসতে বললেন,
"নাহ, আমি শুধু তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হবো।"
মেয়ের সামনে হাসিমুখে এই কথাটা বললেও তিনি বুঝলেন তার মেয়ের এই অভ্যাসের জন্যই তার জীবনে কেউই বন্ধু হয়ে আসেনি। এত বছরেও তিনি বুঝাতে পারেননি তার বন্ধু অন্য কারোরও বন্ধু হতে পারে।
সমাপ্ত
যেটা আমার
অরণী মেঘ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন