বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গল্প: মন ছুঁয়েছে মন

এই পৃথিবীতে এক প্রজাতির মানুষ আছে যারা সিরিয়াস মুহূর্তে খিলখিল করে হেসে দিতে পারে। আমি চাইলেই তাদের দল নেতা হতে পারি। অসম্ভব জটিল মুহূর্তের সময় আমার পেটে কাতুকুতু লেগে যায়। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও আমি কিছুতেই আমার হাসি দমাতে পারি না। আমার সামনে রেগে থাকা মানুষটার কাছে বিনা কারণে আসামি হয়ে যাই আমি।

চতুর্থ শ্রেণীতে থাকতে একবার অংকে ১০০ তে পেলাম মাত্র ১৬!! কাঁচুমাচু হয়ে খাতাটা নিয়ে যখন মায়ের সামনে রাখলাম। মা একটা করে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিল আর তার মুখের অবস্থা ভয়ংকর হচ্ছিল। এমন ভয়ানক মুহূর্তে আমি কিনা খিলখিল করে হেসে দিলাম!এ খন আমার মমতাময়ী মাকে কে বুঝানো দায়, যে আমি ইচ্ছা করে হেসে উঠি নি। কিন্তু এর দায় নিবে কে?আম্মুর চেহারা আরো ভয়ংকর হল, শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে আম্মা আমার নাম নিল।

কেন জানি আম্মা রেগেমেগে আমার নাম নিলে আমি 'অন্তু'র বদলে 'ওয়ান টু' শুনি! আমিও মনেমনে মাইর খাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আবার একবার খেলতে গিয়ে এমন হল যে পাড়ার একবড় ভাই প্রথম বলেই ছক্কা মারতে গিয়ে ইজিলি ক্যাচ আউট হয়ে গেল। সবার সাথে সাথে আমিও কষ্ট পেলাম। কিন্তু যেই না মাঠ ছেড়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল আমি হো হো করে হেসে দিলাম! ব্যাট হাতেই আমাকে দাবড় দিয়েছে ভাই আর হুমকি দিয়েছিল যেন খেলার মাঠে মুখ না দেখাই। কিন্তু কথা হল আজ আমি অংকে ১৬ পাইনি। 

আর না খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে বসে আছে অসম্ভব সুন্দরী ঝর্ণা। কোন এক অজানা কারণে সে রেগেমেগে ফায়ার হয়ে আছে আমার উপর। আমি চেয়েও মনে করতে পারছি না কি ভুল করেছি আমি। কেমন জানি পেটে কাতুকুতু লাগছে। ওদিকে ঝর্ণার মুখ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে রাগে। আমি খুব দ্রুত মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছি কি করেছি আমি। কিন্তু মস্তিষ্ক এই মুহূর্তে রাজি না মনে করাতে।বরং মস্তিষ্ক মামা এই মুহূর্তে ঝর্ণার সাথে আমার ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলা স্মৃতিচারণ করাতে ইচ্ছুক।

ঝর্ণা হচ্ছে অসম্ভব গুণবতী এক কন্যা। যাকে দেখে ক্লাসের প্রায় সব ছেলে পাগল। অতি গুণবান এই কন্যার সাথে যেখানে সবাই একবার ভাব করতে পারলে ধন্য, সেখানে আমার এই জীবনে সাহসে কুলায় নি গিয়ে একটু কথা বলতে। সবসময় দূর থেকেই মঙ্গল কামনাকারী এই আমাকেই কিনা ঝর্ণার মনে ধরলো! বলা নাই কওয়া নাই হুট করে একদিন এসে আমার পাশে বসে পড়ল মেয়েটা। বেশ শান্ত ভাবেই বলল,

- তোমার নাম অন্তু। তাই না?

-জ্বী!

-হুমম,আমাকে তোমার কেমন লাগে?

তব্দা খেয়ে মাটিতে পড়ার অবস্থা হল আমার!ক্লাসের সব নজর কিনা আমাদের উপরে।মনে মনে বললাম,'ভালো লাগে,ভালো লাগে।বড় বেশি ভালো লাগে!' কিন্তু কিছুই বললাম না,

-আচ্ছা বলতে হবে না। কিন্তু তোমাকে আমার ভাল্লাগে। বলা যায় অনেক বেশি ভাল্লাগে!

এবার আমি ঠিক মাটিতে নয়,মাটির ভেতরে ঢুকে গেলাম।সেই সময়টায় আমার পেটে কাতুকুতু শুরু হল এবং খিলখিল হাসির শব্দ মুখ থেকে বেড়িয়ে পড়ল।ঝর্ণা আরো শান্ত গলায় বলল,

- হেসে লাভ নেই, আটকা পড়েছ আমার কবলে।

সেই থেকে শুরু,ঝর্ণা আমার প্রেমিকা। কিন্তু ওর ভেতর প্রেমিকা দের কমন বৈশিষ্ট্য গুলা নেই। মেয়ে একাই একশো। রাস্তা পার হতে তার প্রেমিক লাগে না,রাস্তাঘাটে হঠাৎ কুকুর দেখলে মেয়ে টা ভয় পায় না! ধীরে সুস্থে হেটে যায়।বৃষ্টিবাদলের দিনে বিদ্যুৎ চমকালে কোথায় মেয়েটা ভয়ে চুপসে গিয়ে আমার হাত খামচে ধরবে! তা নয় একটু কেঁপে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। একবার দুজন মিলে হেটে যাচ্ছিলাম, আমার বড় সাধ ঝর্ণার আঙ্গুলে আমার আঙ্গুল রাখার। কায়দা করে যেই না আঙ্গুল ছুঁয়েছি, ওমনি আমার পায়ে জোরেশোরে মেরে দিল এক পাড়া!আমি ব্যথিত হয়ে কাতরাতে কাতরাতে জানতে চাইলাম আকস্মিক হামলার কারণ কি? ঝর্ণা দেবী ভ্রু কুঁচকে জানান দিল চুরি করে আঙ্গুল ধরতে চাওয়ার শাস্তি!আমি গোবেচারা চেয়েও কিচ্ছুই বললাম না।আরেক বিকালে ঝর্ণা বেশ মনোযোগ দিয়ে বাদাম খাচ্ছিল।আমি হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর সিঁথি তে উকুন! কট করে ধরার জন্য বেশ জোরেই চিমটি কাটলাম মাথায়, ঝর্ণার সে কি চিৎকার! আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,'আহহা,উকুন টা পালাবে তো'। ঝর্ণা তীব্র মেজাজে জানতে চাইল কোথায় পেলাম উকুন? আমি ওর কাছে গিয়ে ধীরেধীরে বললাম,'নড়বে না,তোমার সিঁথি তেই'।ঝর্ণা রেগে গিয়ে মাথা দিয়েই আমার মাথায় গুঁতো মেরে দিল!রাগে গজগজ করতে করতে বলল, 'ওরে আহাম্মক!! ওটা তো তিল!'। আমি বেকুব হয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।তবে আমার এই অতিসাহসী প্রেমিকাও একটু আধটু ভয় পায়।কখনও তেলাপোকা উড়ে এসে ঝর্ণার গায়ে পড়লে ঝর্ণা ময়লা ঝাড়ার মতো ঝেড়ে দেয়।কিন্তু ভুলেও ওর নজরে টিকটিকি পড়লে মুহূর্তেই ভয়ে চুপসে যায় ঝর্ণা। জায়গা না বদলানো পর্যন্ত শান্ত হয় না।আবার এক বিকালে একটু গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম বন্ধুরা মিলে।ঝর্ণা পুরাটা সময় প্রানচঞ্চল থাকলেও যেই না এক শিং ওয়ালা গরু দেখেছে ভয়ে দিল এক দৌড়! কারণ ঝর্ণা পরে ছিল লাল সালোয়ার কামিজ , আর ওর বিশ্বাস গরু লাল রং দেখে ওকে দাবড় দিবে।বন্ধুদের সাথে আমিও হেসে কুটিকুটি হয়েছিলাম বলে ঝর্ণা আমার চেহরাই দেখে নি এক সপ্তাহ!

মস্তিষ্ক আরো কিছু মনে করাতে চাইল,কিন্তু আমি মস্তিষ্কের সাথে লড়াই করে বাস্তবে ফিরে এলাম।ঝর্ণা এখনও রেগে আছে।আমি জানি জানতে চাইলে মেয়েটা আজ আমার মার্ডার করে দিতে পারে।কিন্তু বুঝাই কিভাবে? আমার সত্যিই মনে পড়ছে না কি দোষ করেছি!নাকি একাই নদীর পাড়ে হাটতে এসেছি বলে ঝর্ণা রাগ করেছে? কিন্তু করার তো কথা না!কারণ ঝর্ণা সাফসাফ জানিয়েছে ও যদি মানা করে আমি যেন ভুলেও জোর না করি দেখা করতে।আর আজ কেন জানি ঝর্ণার কথা মনে পড়ছিল খুব আমার। তাই ভাবলাম যাই একটু নদীর পাড়টায় ঘুরে আসি।এই জায়গা টা ঝর্ণাই চিনিয়েছে।কখনও আমি একা আসি না,ঝর্ণার সাথেই আসা হয়। আজই প্রথম একা এসেছিলাম। কিন্তু আসার পর দেখি ঝর্ণাও এসেছে।ওকে দেখেই খুশিতে দৌড় মারতে মারতে এলাম। কিন্তু তারপর থেকেই দেখছি সে রেগেমেগে ফায়ার। আর পারছি না। একে তো পেটের কাতুকুতু, দ্বিতীয়ত ঝর্ণার রাগ।হাসি চেপে জানতে চাইলাম,

-আহা, বলই না হয়েছে কি?

ঝর্ণা সরু চোখে তাকালো আমার দিকে, 

-তুমি এখন এখানে কি কর?

আমি এবার হেসেই দিলাম।

-আরে কি আর? হাটতে এলাম।

হাসতে হাসতে যেই না বললাম কথাটা, ঝর্ণা চিৎকার দিয়ে আমার নাম নিল।আমি প্রথমবারের মতো 'অন্তু'র বদলে 'ওয়ান টু' শুনলাম ঝর্ণার মুখে!তারপর শুরু হল এলোপাথাড়ি মাইর।পিঠের উপর,পেটের উপর ধরামধরাম কিল ঘুসি! আমি আত্মরক্ষা করতে পারলাম না।ঝর্ণা বেশ কিছুক্ষণ পর থেমে গেল।আমি এবার অসহায়ের মতো জানতে চাইলাম আমার অপরাধ টা কি? ঝর্ণা মুখ ঘুরিয়ে নিল আমার থেকে।

বলবে না বলবে না করেও ঝর্ণা বলেই দিল রাগের কারণ। আজ আমাদের দেখা করার কথা ছিল এইখানেই তিনটার দিকে।আমার আসতে আসতে সন্ধা! বেচারি সেই তিনটা থেকেই বসে আছে একা একা।আমি তব্দা খেয়ে ওকে থামিয়ে বললাম,

-আমাদের না আগামীকাল দেখা করার কথা?

-অন্তু!!

-না ঝর্ণা আজ তো রোববার!

ঝর্ণা হতাশ হয়ে বলল,

-আহাম্মক রে,আজ সোমবার! 

আমার মস্তিষ্ক তাৎক্ষণিক আমাকে মনে করিয়ে দিল, বেশ কয়দিন হল আমি ফোন কিংবা ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বুলাইনি!আসলে কি করে যে ঠিক একদিন পিছিয়ে চলছি মাথায় আসছে না!আম্মার কথা মাথায় আসছে। আম্মা বলে মাঝেমাঝে পেপার পড়তে,দিন দুনিয়ার খোঁজখবর রাখতে।কোন কারণ ছাড়াই এবং সম্পূর্ণ একদিন পিছিয়ে চলার কারণে আজ দেখা করার কথা থাকলেও আমি আগামীকালের অপেক্ষায় ছিলাম।আর ফোনটাও মনের ভুলে রেখে এসেছি তাই ঝর্ণা কল করেও পায়নি আমাকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আজই আমাদের দেখা হয়েছে। আমার বেহুদা এক ভুলের কারণে ঝর্ণা একা একা এখানেই বসে আছে এতক্ষণ! ভাবতেই ভাললাগা এবং খারাপ লাগা বয়ে গেল বুকের ভেতর। ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে দেখি চোখজোড়া লাল হয়ে উঠেছে। আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আমি সাহস করে ঝর্ণার হাত ধরে ঘটনা খুলে বললাম। ঝর্ণা কিছুই বলল না।বসে পড়ল। আমিও হাত ছেড়ে দিলাম। 

পুরোপুরি অন্ধকারে ছেয়ে গেছে আকাশ।বাতাস বইছে তীব্র।দূর আকাশে যেন মেঘ জমেছে একদম গুমট অন্ধকার। বাতাসে ঝর্ণার চুল উড়ছে।চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আমার নাকে এসে ঢুকছে কিন্তু মনে এসে লাগছে। এত মনোরম পরিবেশেও মশা কানের কাছে ভোঁভোঁ করছে,পায়ে কামড়াচ্ছে। আমি ঠিক ভদ্রতার খাতিরে নয় বরং ঝর্ণার ভয়েই একটুও নড়ছি না।সেই সুযোগে মশা আচ্ছা মতো কামড়ে নিচ্ছে। যাহ দিলাম আজ তোদের রক্তদান! ঝর্ণার জন্য না হয় একটু কামড়ই খেলাম। ঝর্ণা যখন প্রথম বলেছিল আমাকে পছন্দ করে,আমি ভেবেছিলাম মজা করছে।কারণ অন্যছেলে দের তুলনায় আমি ওকে বেশিই পছন্দ করতাম।তীব্র ভাললাগা কাজ করত ওর প্রতি আমার।সেই ভাললাগার মানুষ টাই যখন নিজে এসে বলল তার মনের কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি চাচ্ছিলাম সেই মুহূর্ত টা ধরে রাখতে,একান্ত নিজের করে রাখতে।তারপরের দিন গুলা স্বপ্নের মতো কাটছে। ঝর্ণার কাছে যে সত্যিই আমি স্পেশাল, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। যে মেয়ে আমার মতো হ্যাবলার জন্য একা এতক্ষণ বসে ছিল, যেখানে আমার আসার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তাও অপেক্ষা করেছে, তার কাছে আমি সত্যিই স্পেশাল। এতো দিনের সম্পর্ক আমাদের, আমি শুধু ঝর্ণাকে ভালবেসেই গেয়েছি।পুরো সম্পর্ক টিকে আছে ঝর্ণার কারণে।বিশেষ কিছু কখনই করি নি ওর জন্য।তবে অনুভূতি আমার নিখাত।চাইলেই যে কেউ বদলাতে পারবে না। এমন সময় আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম!পাশে আড় চোখে তাকিয়ে দেখি ঝর্ণা নড়ছে না একটুও। সেই থেকে ঝর্ণা চুপ করে বসে আছে।নীরবতা ভেঙ্গে বলল,

-অন্তু

-হ্যাঁ, বল

-আমি বেশ কঠিন এক মেয়ে, তাই না? তুমি চেয়েও আমাকে কিছুই বলতে পারো না!

-না, ঝর্ণা। তুমি কঠিন বলেই আমি তোমার মাঝে মিশে থাকতে পারি, তোমাকে কিছু বলতে নয় বরং তোমার কথা শুনতেই আমার ভাললাগে।

-না অন্তু,অন্যদের মতো আমি তোমার খেয়াল নেই না,কোন আবদার রাখি না, নিজের খেয়ালখুশি মতো হুকুম চালাই! এতে তো তোমার খারাপ লাগে।তাই না?

আমি আরেকবার সাহস করে ঝর্ণার হাত টা ধরলাম,

-না ঝর্ণা খারাপ লাগে না। তুমি কঠিন বলেই আজও তোমাকে আমার পাশে পাই।নাহলে সেই কবেই আমি ছিটকে পড়ে যেতাম। তোমার কারণেই এই মায়ার বাঁধনে আছি আমরা। তুমি যেমন ঠিক তেমনই আমার প্রিয়। সবচেয়ে প্রিয়।

ঝর্ণা কিছু না বলেই টুপ করে ওর মাথা টা আমার কাঁধে রেখে দিল। এই প্রথমবার ঝর্ণা আমার এত কাছে এলো।ওর চুলের ঘ্রাণ আরো কাছ থেকে পাচ্ছি। আমার ভেতর একটা ভাললাগা বয়ে যাচ্ছে।এক অনুভূতির দেখা মিলছে। সেই দিনকার অনুভূতি, যেদিন ঝর্ণা প্রথম সবার সামনে বলেছিল ওর আমাকে ভাল লাগে। অদ্ভুত এই নীরবতার মাঝেও আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি ঝর্ণা আমাকে বলছে,'ভালবাসি!'

-Fariha Jerin


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন