বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

একজন নাদিয়ার জীবনের গল্প

নাদিয়ার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ। এগারো সন্তানদের মধ্যে নাদিয়া ছিল সপ্তম। দেখতে সে তেমন সুন্দর না হলেও তার চেহারায় এক প্রকার মায়া ছিল। মানুষের মন জয় করতে পারত। নাদিয়া ছোটবেলা থেকেই ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। ডানপিটে ছিল। তার বাবা পুলিশ সুপার ছিল বলে তাদের কেউ কিছু বলত না।সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াত, ছোট ভাই বোনদের দেখাশুনা পড়ালেখা ভাল চলছিল, সেই সাথে মারপিটও। ডানপিটে হওয়ায় ছোট হলেও বড় বোনদের সেই প্রটেক্ট করত।

এইতো এভাবেই চলছিল জীবন । ছোট্ট নাদিয়া বড় হচ্ছিল কিন্তু তার ছেলেমানুষি একটুও  কমেনি। নাদিয়ার বড় ভাইয়ের বন্ধুরা বাসায় আসত আড্ডা দিত মজা করত। সেই সুত্রেই দিলু নামের একজনের সাথে পরিচয় ছিল নাদিয়ার। সেও বড় ভাই এর বন্ধু ছিল। সে নাদিয়াকে ভালবাসতো । কিন্তু নাদিয়া এসব বুঝত না। পাত্তা দিত না। সে কথা বলতে আসলে নাদিয়া দৌড় দিত। না হয় তাকেই তাড়া করত। নাদিয়ার এই চঞ্চলতাই দিলুর পছন্দ ছিল।

হঠাৎ নাদিয়াদের ট্রান্সফার হয়ে যায়। এবার নাদিয়া কিছু একটা বুঝতে শুরু করে।

মনের মধ্যে কেমন যেন করছে !!!!! কিছু ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই নাদিয়ারা কুষ্টিয়াতে চলে আসে। শুরু হয় নতুন এক জীবন। হঠাৎ একদিন নাদিয়ার বড় ভাইয়ের এক বন্ধু নাম শাহিল নাদিয়াকে বিকেল এ তাদের বাড়িতে আসতে বলে। কৌতুহল নিয়ে নাদিয়া যায় তাদের বাড়িতে।

শাহিল তাকে একটি চিঠি দেয় বলে দিলু পাঠিয়েছে । নাদিয়া ভীষণ অবাক হয় । একটানা চিঠিটা পড়ে। পড়া শেষে বলে আমি কী করব ? শাহিল অবাক হয় বলে কী করবা মানে এর উত্তর দিবা। নাদিয়া বলে কী উত্তর দিব? শাহিল বলে আচ্ছা আমি যা বলব তাই লিখে দাও। নাদিয়া রাজি হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই বলে চিঠির উত্তর দিচ্ছি ঠিক আছে আমি কিন্তু সিনেমার মত নাচ গান করতে পারব না। শাহিলের এ কথা শুনে হাসতে হাসতে পাগল হওয়ার মত অবস্থা।

শাহিলের সাহায্যে নাদিয়া দিলু কে চিঠিও লিখতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পর দিলু নাদিয়াকে একটা চিঠি লেখে যাতে লেখা ছিল তুমি আসলে বোকা একটা মেয়ে! তোমার সাথে এমনি কথা বলা যায় প্রেম করা যায় না তুমি প্রেমপত্র লিখতে পার না।

ব্যাস বন্ধ হয়ে যায় তাদের যোগাযোগ !!!!! এরপর কেটেগেছে অনেক বছর কোন যোগাযোগ হয়নি তাদের। নাদিয়া যখন ইন্টার পড়ে তখন দিলু হঠাৎ করে ফিরে আসে। নাদিয়ার ইন্টার পরীক্ষার পর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় দিলুর পরিবার।পারিবারিক ভাবে সব ঠিক হয়। সবকিছু ঠিক ছিল বিয়ের যাবতীয় কাজ প্রায় শেষ । তার মাঝে হঠাৎ দিলুর মা নাদিয়াদের বাড়িতে আসে !!!! নাদিয়ার মাকে বলে দিলু বিয়ের পর দিলু আমেরিকা যাবে দিলু পাঠানোর খরচ তাদের বহন করতে হবে। নাদিয়ার মা কিছুতেই রাজি হলেন না। ব্যাস ভাঙ্গে গেল নাদিয়ার বিয়ে। নাদিয়ার ছোটবেলার প্রেম ভেঙ্গে গেল। হারিয়ে গেল সাজানো হাজারও স্বপ্ন।

দিলু চেয়েছিল নাদিয়াকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে । কিন্তু অরপা তার পরিবারের মানসম্মানের কথা ভেবে দিলু কে ফিরিয়ে দেয়। ৬মাস দিলু নাদিয়ার জন্য অপেক্ষা করে অন্যত্ত্র বিয়ে করে। আর নাদিয়ার শুরু হয় দুবিষহ কষ্টের একাকী জীবন।

বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া টা নাদিয়ার জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছিল। তার পরিবারের কাছে এটা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। যার কারনে তারা নাদিয়াকে অবহেলা করতে থাকে। নাদিয়া মুখ বুজে সব সহ্য করতে থাকে। কিন্ত পরিবারের সবার আচরন এতটাই খারাপ ছিল যে নাদিয়া বাসা থেকে না বলে চলে আসে ঢাকাতে, বড় ভাই এর বাড়িতে থেকে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে নেয়!! মোটামুটি ভালই চলছিল নাদিয়ার জীবন! 

বাবা মা নাদিয়াকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিতে থাকে। কিন্তু নাদিয়া বাবা মার পছন্দে বিয়ে করবে না। তাই সে জেদ করে অল্প কিছুদিনের পরিচিত এক ব্যক্তি কে বিয়ে করে। লোকটা ছিল নাদিয়ার এক কলিগ। এটাই ছিল নাদিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। বিয়ের ৪দিন পর থেকে নাদিয়া  লোকটার অসল রুপ দেখতে পারে। স্বভার চরিত্রের দিক থেকে লোকটা ভাল ছিল না। কিন্তু নাদিয়ার আর কিছু করার ছিল না… সে তার ভাগ্য মেনে সংসার করছিল! বিয়ের ৪ বছরে ২ বাচ্চার মা হয়ে নাদিয়া মেনে চলছিল তার ভুলে ভরা জীবন এই আশায় হয়তো কখনো সে সুখের মুখ দেখবে ! সুখ তার কপালে ছিল না!! নাদিয়ার স্বামী বিদেশ চলে যায় । বিদেশে যেয়ে লোকটি প্রথযে কাজটি করেছিল তা হল আর  একটা বিয়ে করা। এবারও নাদিয়ার কিছু করার ছিল না। বাধ্য হয়ে ২ ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়ি , শুরু হয় নতুন সংগ্রাম ছেলে মেয়ে কে লেখা পড়া শিখানো সংসারের সব দায়িত্ত নাদিয়ার উপর এ পরল ।

অনেক কষ্ট করে সে তার সন্তানদের লেখা পড়া শিখাছে । ভাই বোনদের অপমান সহ্য  করে সে বাবার বাড়ীতে পরে আছে! শুধু এই আশা নিয়ে যে ছেলে মেয়ে বড় হয়ে তার দুঃখগুলো দূর করবে নাদিয়ার জীবন আর অনেক সময় পার হয়ে গেছে!! এখন তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি এখনও সে তার বাবার বাড়িতে থাকে তার দুই সন্তান কে নিয়ে চার বছর আর একটা ছোট মেয়েও আছে তাকে নাদিয়া দত্তক নিয়েছে। 

এই ভাবে চলছে নাদিয়ার অপূর্ণ একটা জীবন । প্রতিটা নারীর মাঝে একটা নাদিয়া আছে । কেও নিজের জীবন টা কে নতুন করে সাজিয়ে নেয় আর কেও তার সন্তানদের নিয়ে বাঁচে। আমি সেই নাদিয়ার সন্তান যে নাদিয়া নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তান দের নিয়ে বেঁচে আছে। আমি গর্বিত এমন নাদিয়ার সন্তান হয়ে।

By: Addri Ahmed সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন