রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অনুগল্প: স্মৃতির পাতায় বন্ধুরা

রুমটা গোছাতে গোছাতে হথাৎ করে একটি ব্রেসলেট চোখে পড়লো আমার। ব্রেসলেটটি দেখেই চোখের পাতায় হাজারো স্মৃতি ভেসে উঠলো। 

একদিন শখ করে তিনটা ব্রেসলেট কিনেছিলাম আমরা তিন বান্ধবী। আমি, নুসরাত আর নাদিয়া টুকটাক কিছু জিনিস কেনাকাটা করতে গিয়েই পছন্দ করেছিলাম এই ব্রেসলেটটা। পরে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম তিনজনের জন্য তিনটে। 

নুসরাত ছিলো একদম শান্ত স্বভাবের। আমাদের সাথে যা-ও একটু কথা বলতো বাকিদের সাথে তেমন বলতোই না। মন খারাপ হলেও ওকে হাজার বার কারন জিজ্ঞাসা করতে হতো। কিছুতেই বলতে চাইতোনা। 

আর নাদিয়া আর আমি ছিলাম নুসরাতের একদম বিপরীত স্বভাবের। যাকে বলে চঞ্চল। সারাদিনভর চিৎকার, চেঁচামেচি, লাফালাফি, দুষ্টামি সব ছিলো আমাদের নিত্যদিনের কাজ। আমাদের জন্য বেচারি নুসরাতকেও কত যে বকা খেতে হতো হিসাব নেই। 

স্কুলে এমন কোনো কর্মকান্ড ছিলোনা যেখানে আমরা তিনজন উপস্থিত থাকতাম না। আর স্কুলের পরিচিত তিনটি মুখ ছিলাম আমরা। শিক্ষকদের কাছেও আমরা তিনজন মোটামুটি পছন্দের স্টুডেন্ট ছিলাম।

কে আগে বিয়ে করবে, কার স্বামী কেমন হবে এসব নিয়ে আলোচনা ছিলো নিত্যদিনের। ভবিষ্যৎ নিয়ে কত ভাবনা চিন্তাই না করতাম আমরা। 

কিন্তু তখন কি জানতাম যে আমাদের ভবিষ্যৎ এমন হবে? আলাদা করে দিবে আমাদের তিনজনকে! 

মনে পড়লো এক বিকেলের কথপোকথন। 

নুসরাতের বাসায়আড্ডা জমাতে হাজির হয়েছিলাম আমি আর নাদিয়া। 

সেদিন আন্টি জরুরি তলব করেছেন। তারপরই জানতে পারলাম নুসরাতের নাকি বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে। আর আজকে পাকা কথা হবে।

আমি আর নাদিয়া হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। আমরা এরকম কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আন্টি এসে বললেন, 

"মা, তোমরা দুজনে তোমাদের বান্ধবীকে একটু বোঝাও তো! বিয়ের কথা শুনেই কেমন রাগারাগি করছে দেখো না। তোমরা বোঝালে সে নিশ্চয়ই বুঝবে।"

আন্টির কথা শুনে আমরা তখন নুসরাতের কাছে গেলাম। মনের ভাবটা সম্পুর্নরুপে প্রকাশ না করে মুখে মিথ্যে রাগ নিয়ে বললাম,

" কিরে? শয়তান, বাদর, বেদ্দপ মাইয়া বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আর আমাদের বলিস নাই পর্যন্ত? সত্যি সত্যি দাওয়াত না দেয়ার প্ল্যান করছিলি তুই? কিপ্টা মাইয়া। "

আমার কথায় তাল মিলিয়ে নাদিয়াও বলে উঠলো, 

"দেখছিস, সানজিদা? কি পরিমানে বজ্জাত এই মহিলা? আমাদের একবারো বললো না। আর আন্টি আজ না বললে তো জানতেই পারতাম না। "

নুসরাত তখন আমাদের দিকে কেমন যেন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। চোখ দুইটা ছলছল করছে ওর। কখন বলে টুপ করে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরবে পরবে ভাব।

ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো, 

"দোস্ত আমি বিয়েটা করতে চাইনা রে। কিন্তু বাসা থেকে খুব প্রেশার দিচ্ছে। এতোকিছুর মধ্যে তোদের কি বলবো বুঝে উঠতে পারিনি। "

আমি আর নাদিয়া নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে নুসরাতের পাশে গিয়ে বসলাম। মাথায় গাট্টা মেরে বললাম, 

" হইছে। থাম এখন। এতো ইমোশনাল হওয়া লাগবেনা। এখন ট্রিট দেয়ার জন্য রেডি হও সোনা। আমরা কিন্তু ট্রিট না নিয়ে ছাড়ছি না।"

নুসরাত মুচকি হেসে বললো, "তোদের সাথে সম্পর্কটা সবসময় এমন থাকবে তো? হারিয়ে যাবেনা তো এই শহরের মাঝে? স্মৃতি হয়ে যাবেনা তো সবকিছু? "

আমরা বলেছিলাম, "উহু, একদমই না। আমরা সবসময় এরকমই থাকবো। এখন যেমন আছি ঠিক তেমনই থাকবো। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে চিরকাল। দেখে নিস তুই "

বলেই আমরা তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। 

সেদিনকে ব্যাপক আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলি বললেও সেগুলি আর রাখা হয়নি আমাদের। আজ এতোগুলি বছরপর এসে দেখলাম সবকিছুই স্মৃতি হয়ে গেছে। আমরা তিনজন এখন যার যার অবস্থানে ব্যস্ত। কথা হয়না। দেখা হয়না আমাদের। 

আমরা কেউই আগের মতো নেই। সবার জীবনে নতুন নতুন মানুষ এসেছে। আগের সবকিছুই স্মৃতির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বন্ধুরা এখন স্মৃতির পাতায়। 

আসলে সময় কখনো স্থির থাকেনা। স্থির থাকেনা মানুষের জীবনও। সময় পরিবর্তনশীল। তবে সে শুধু নিজেই পরিবর্তন হয়না। নিজের সাথে সাথে চারপাশের মানুষ,জীবন, জগৎ, আবেগ,অনুভূতি, ভালোবাসা, ভালোলাগা সবকিছুকে পরিবর্তন করে দেয়। 

ব্রেসলেট টা হাতে পড়লাম। মনে মনে ওদের জন্যে প্রার্থনা করলাম তারা যেন যেখানেই থাকে ভালো থাকে। স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব গুলি সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর হয়। ভালো থাকুক সব বন্ধুত্বগুলি। আমাদের মতো হারিয়ে না যায় যেন তাদের বন্ধুত্ব। 


সানজিদা তাসনিম জুঁই (লেখিকা)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন