শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২২

অন্যরকম এক মেয়ের গল্প

কয়েক মাস আগে আমাদের গত দশ বছর ধরে সেবা দেওয়া গৃহকর্মী মেয়েটি বিদায় নিবে, ওর বাবা মা বিয়ে ঠিক করেছেন। বড় মেয়ে শাবনুর এসে বলল,

- পাপা প্লিজ, আমরা সবাই মিলে ওকে একটি ফেয়ারওয়েল ট্রিপ দিব, সিলেটে।

সিলেট বেড়াতে গেলাম সবাইকে নিয়ে। শাবনুর ওর সাথে আলাদা রুম নিয়ে থাকল, ঘুরল, শপিং করল, খাওয়া দাওয়া করল।

গৃহকর্মী মেয়েটি আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় প্রচুর কাঁদল। যাওয়ার পরেও নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নিত।

- চাচা, আপনাকে ঠিকমত নাস্তা দেয়া হয়েছে তো?

সেদিন শাবনুরের জন্মদিনে রাত ১২ টার পরপর ঢাকার শ্বশুরবাড়ি হতে সবার আগে ফোন কল দিল এই মেয়েটিই।

ওর কাছ থেকেই শিখেছি, গৃহকর্মীদের সঙ্গে কি করে আরও মানবিক হওয়া যায়। ওর জন্মদিনে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে জন্মদিন পালন করতে চাও?

শাবনুর বাসার দুইজন গৃহকর্মীকে দেখিয়ে বলল,

- পাপা, আমরা আজকে চাইনিজ খেতে যাব আর ওরা দুজনও আমাদের সঙ্গে যাবে।

- আচ্ছা মামনি।

কিছুদিন আগে ছোট মেয়ে ইনারার জন্মদিনেও শাবনুর এভাবে পালন করেছে।

ওর ছোট খালা অর্থাৎ আমার শ্যালিকার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে, শাবনুর এসে বলল,

- পাপা, আমাদের ফ্যামিলি প্রোগ্রামে ওদের জন্যে পার্টি পোশাক কিনতে হবে।

- আচ্ছা মামনি।

১৫০০ টাকা বাজেটে না হওয়াতে ওর জমানো ৭৫০ টাকা যোগ করে অবলীলায় ড্রেস কিনে এনেছে। অবাক হলেও আমি কিছু বলিনি। এই বয়সে এত হৃদয়বান কিংবা মানবিক আমরাও ছিলাম না।

গৃহকর্মীদের স্ঙ্গেই উঠেবসে, একই বিছানা শেয়ার করে, টেবিলে পাশাপাশি বসে লাঞ্চ ডিনার করে, রমজানে ইফতার করে, গল্প করে পাশাপাশি ডেস্কটপ পিসিতে বসে, নাটক তৈরি করে সবাইকে দিয়ে অভিনয় করায় আবার, ওদের ভাল মন্দও দেখাশোনা করে। আমার কাছেই ওর আস্ত একটি এলবাম রয়েছে, ওদের বিভিন্ন সময় তোলা গ্রুপসেশন, নাটক ইত্যাদি ছবির। তার মানে আবার এমনটি নয় যে, স্কুলের বন্ধুদের সাথে ওর দূরত্ব আছে। সব বন্ধুত্বই ওর মত করেই ব্যালেন্স করে চলে।

ওর জন্মের আগে আমি একটি কন্যা সন্তান চেয়েছিলাম, আমার স্ত্রীও তাই। আলট্রাসনোগ্রামের রেজাল্টে তাই আমরা তখন হাসিমুখেই বাসায় ফিরেছিলাম। ৬ পাউন্ডের তুলতুলে জীবনটিকে যখন আমার হাতে নার্স এসে তুলে দিয়েছিলেন, মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটাই যেন আমার হাতের মুঠোয়। ওর কানে আমি আজান দিতে দিতে ভাবছিলাম মেয়েটি একটি মায়াবতী, ধার্মিক আর ভাল মনের মানুষ যেন হয়।

এসএসসির আগে ওর জমানো টাকাগুলি দিয়ে এক সহপাঠীর অসুস্থ পিতার জন্যে সুস্থতার নিয়তে দান করেছিল আর একজন সহপাঠীর এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে গোপনে স্কুলে যেয়ে জমা করে এসেছিল। এই দুটো কাজই শাবনুর করেছিল গোপনে। 

আর এবার এসএসসিতে ভাল ফল করে পাওয়া টাকাগুলির একটি বড় অংশ দিয়ে নবজাতক এক শিশুর জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু কেনাকাটা করে পাঠিয়েছে। কিছুদিন পরেই আমাদের বাসা থেকে ছেড়ে চলে যাওয়া সেই গৃহকর্মীর সন্তানের জন্মানোর তারিখ। আমরা ওর কোনো কাজেই বাধা দিই না, বরং উৎসাহ দেই। 

স্বভাবে বেশ অলস হলেও শাবনুর মানবিক গুণগুলোতে আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। আল্লাহ এই মেয়েটিকে একটি স্পেশাল শ্রেণী বৈষম্যহীন মানবিক হৃদয় দিয়ে পাঠিয়েছেন। ওর আচরণ হতে আমরাও শিখেছি, এখনো নিয়মিত শিখছি। অন্যরকম এক মেয়ের গল্প।

কন্যাসন্তান সত্যিই এক আশীর্বাদ। 


writer: Atique Ua Khan

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন