সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গল্প: বড় আপার বিয়ে

৪৭ বছর বয়সী বড় আপার জন্যে চারদিকে যখন বর খোঁজা হচ্ছিল তখন উৎসাহের চেয়ে বঞ্চনাটা বেশি শুনতে হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী তো ছিলই সাথে আত্মীয় স্বজনরাও কটু কথা বলতে ছাড়ে নি। কেউ কেউ তো মুখের ওপরে বলেই বসতো যে, বুড়া বয়সে ছেলে খুঁজলে কি আর ছেলে পাওয়া যায়? তাছাড়া দিনকাল যা পড়েছে তাতে কোন ছেলের গরজ পড়েছে যে এমন বয়স্ক মেয়ে বিয়ে করবে। তাও আমরা থামি নি। 

মূলত সবার একটাই সমস্যা ছিল আপাকে নিয়ে আর সেটা হলো আমার আপার বয়স ৪৭ যা বর্তমানে বিয়ের বয়স হতে অনেক বেশি। কিন্তু তাতে কি, আল্লাহ চাইলে আমার মা সমতুল্য আপার জন্য অবশ্যই ভালো ছেলে পাওয়া যাবে।

আমি আর হালিম আমরা টুইনস। বড় আপা আমাদের থেকে বয়সে প্রায় বিশ বছরের মতো বড়। সত্যিকার অর্থে আপার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। আমার মা বাবার বিয়ের প্রায় ৭ বছরেও যখন বাচ্চা হচ্ছিল না তখনি দু'জনে মিলে আপাকে ৫ বছর বয়সে দত্তক নেন। আর আপাকে নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করে। যেহেতু আমার বাবা মার তখনও কোনো সন্তান ছিল না তাই তারা চেয়েছিলেন আপাকে যাতে একটু দেরীতে বিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যে ঘটে গেলে একটা মিরাকেল।আল্লাহ চাইতেই হঠাৎ করে আমার মা কনসিভ করেন আর সেই সুখে আমার বাবা মা প্রায় আত্মহারা হয়ে পড়েন। অনেক জল্পনা কল্পনার মাঝে যখন আমরা দুই ভাই বোনের জন্ম হয় তখন আমার পরিবারে আনন্দের জোয়ার চলতে থাকে। এর মাঝে অনেকের মনে আপাকে নিয়ে চিন্তা শুরু হয় কেননা একে তো আপা বিয়ের উপযুক্ত তার ওপরে আবার আমাদের জন্ম তাই অনেকে ধারণা করে যদি আমাদের নজর দিতে গিয়ে আপাকে অবহেলা করা হয়। কিন্তু না তেমন কিছুই হলোনা কারণ আমার বাবা মা ভাবতে লাগলেন আপার সৌভাগ্যে আমরা তাদের কোলে এসেছি তাই তারা আপার প্রতি তাদের স্নেহ আরো বাড়িয়ে দিলেন যাতে কেউ সমালোচনা করতে না পারে। সুখ অপার্থিব বস্তু যা হয়তো সকলের কপালে সয় না আর সেটা ঘটলো আমাদের সাথে। আমাদের জন্মের পর বাবা মা মানত করেছিলেন, আমাদের বয়স ৫ হলে তারা আল্লাহর নামে এক মাজারে গরু দিবেন আর সেটার জন্য তারা আমাদের আপার কাছে রেখে মাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন।দুর্ভাগ্যবশত যে গাড়িতে যাচ্ছিলেন সেটা এক্সিডেন্ট হয় আর তখনি স্পট ডেটে মারা যান বাবা মা।এরপর আমার বড় আপা একা হাতে আমাদের মানুষ করেন।অনেক মানুষ আপাকে বুঝিয়েছিলা যাতে আমাদের এতিমখানায় দিয়ে আপা বিয়ে করেন আবার অনেকে বলেছিল যাতে আমাদের দত্তক দিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু আপা কারো কথা কানে নেননি বরং সবার সাথে ঝগড়া করেছিলেন এসব কথার জন্য। 


আপার ভাষ্য মতে,

"আমি বেচে থাকতে আমার ভাইবোনকে আমি আলাদা করবো না।তাদেরকে ছেড়ে অন্য কোথাও আমার সংসার সম্ভব না।বরং তাদের নিয়েই আমি সংসার করবো।আমার বর্তমানে কেউ তাদের এতিম বললে জিভ ছিড়ে ফেলবো।আমার বাবা মা আমাকে দত্তক নিয়েছেন বলে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি পরিচয় পেয়েছি, তাদের কলিজাকে আমি অন্য কারো হাতে দিব না। ওরা আমার কাছে আমার বাবা মার রেখে যাওয়া আমানত যাদের মানুষ করা এখন আমার কর্তব্য। এরজন্য যদি আমার সারাজীবন একা থাকতে হয় তাও থাকবো কিন্তু আমি আমার ছোট ভাইবোনকে রেখে কোথাও যাব না।"

দিন,মাস,বছর গুনতে গুনতে ২২ টা বছর বড় আপা আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন। এরমধ্যে আমার বিয়ে দেন, হালিমের জন্য মেয়ে ঠিক করেন কিন্তু বড় আপা আর বিয়ে করেন নি।কত শত প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু আপা নাকচ করে দেন। একটাই জবাব ছিল, "আগে আমার বাবা মার আমানত রক্ষা করি,আমার ভাইবোনকে মানুষ করি,তাদের একটা কূল কিনারা করি তারপর আমার কথা ভাববো।"

আপা আমাদের নিয়ে এতটাই মশগুল ছিলেন যে কখন তার জীবনের ৪৭ টা বসন্ত চলে গেলো খবরই নিলো না। আর কতো আমানত নিয়ে ভাববে আমার আপা।তাই আমি আর হালিম এবার সিদ্ধান্ত নিলাম আপাকে বিয়ে দিব আর কথাটা আপাকে বলতে আপা গররাজি হয়ে গেলো। কিন্তু তাতে কি যেমন আমাদের আপা তেমনি আমরা। বলে কয়ে আমরা আপাকে নিমরাজি করালাম কিন্তু বাঁধ সাধলো এ সমাজ আর সমাজের শিক্ষিত জাতি।তাদের বয়ানে,"এ বয়সে বিয়ে করে লাভ কি,যৌবন তো ফুরিয়ে গেলো তার ওপর বাচ্চা কাচ্চা হবেও না। আর বিয়েটা করবেই বা কে, পারলে যেন একটা বুড়োকে বিয়ে দিয়ে দাও"।এসব কথা প্রথমে আমাদের কানে আসতো কিন্তু পরে আপার কানে গেলে আপা বেঁকে বসে।তাও আমরা পরোয়া করলাম না ছেলের খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। তার মধ্যে অনেকে উপহাস করতে শুরু করে কিন্তু আমরা আমাদের লক্ষ্যে অটল রইলাম।

সন্ধ্যার দিকে আপার রুমের পাশে যেতে দেখি কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।আপা কাঁদছে ভাবতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো।দরজাটা হালকা ফাঁক করতে দেখি অন্ধকার রুম।পা টিপে টিপে দেখি বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে বড় আপা।আমার এমন শক্ত আপাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি কিন্তু মানুষের কথার আঘাত এতটা ভায়বহ যে তারা আমার আপাকে আঘাত করেছে। পিঠের ওপর হাত রাখতে আপা নিজেকে সামলে নিলো কিন্তু আমি আপাকে কিছু বলতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। ছোট থেকে যে মানুষটা কখনো আমাদের চোখের জল ফেলতে দেয় নি শুধুমাত্র এ সমাজের কদাকার মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে আপাকে কাঁদতে হচ্ছে। এরচেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণা আর কিছুই হতে পারেনা।

আলহামদুলিল্লাহ আজ আমার বড় আপার বিয়ে সম্পন্ন হলো তাও আপার চেয়ে বয়সে ১০ বছরের জুনিয়র একজন অবিবাহিত  মানুষের সাথে যিনি কিনা আরবীতে একজন পাশ করা আলেম আর বাংলাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আজকে এখন সেসব কুৎসিত মানষগুলোর মুখশ্রী দেখতে ইচ্ছে করছে যারা কিনা বড় আপাকে নিয়ে নিন্দা সমালোচনা করতো। সহজ সরল মানুষকে নিয়ে  সমালোচনা করতে সবার ভালোই লাগে কিন্তু তারা বুঝতে পারে না  ভাগ্য  তাদের হাতে নয়, সৃষ্টিকর্তার হাতে যিনি চাইলে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে পারে।


by তানিয়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন