সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২২

গল্প- অলিকের আশা

মেয়েটি সুন্দর। ভীষণ সুন্দর।

আয়নায় যখন মেয়েটিকে দেখি, চোখের পলক ফেলানো দায় হয়ে যায় আমার। এতো সুন্দর কেউ থাকতে পারে, তাকে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। তার চোখ, মুখ, নাক সব যেন মাপমতো বসানো হয়েছে তার চেহারায়‌। গায়ের রং তামাটে, লাতিনো মেয়ের বন্য আকর্ষণ ফুটে আছে তার মুখে‌। চোখ দুটো নেশা ধরানো।
আমি দুই চোখ ভরে তাকে দেখি। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাই না আর তখন। সে আমায় দেখে হাসে। তার বাঁকা হাসিতে যেন আমার যেন নেশা ধরে যায়। স্বপ্নালু চোখে নেশার ঘোরে টলতে থাকে আমার চারপাশ।
সে হাসতেই থাকে। তার হাসি মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে।
সকালে নিজেকে মেঝেতে আবিষ্কার করি। আলুথালু বেশ। সারারাত মেঝেতে শুয়ে জ্বর-জ্বর ভাব আসে সারা শরীরে। সেই জ্বরভাব নিয়ে অফিস করি। বিকেলে কলিগদের সাথে চা খাই। রাতে শহরের লাল-নীল বাতি দেখতে দেখতে বাসে বসে ঠিক করি, আর ওকে দেখবো না কোনোদিন।
এভাবে কিছুদিন যায়।
এরপর আবার মাদকাসক্তের মতো তীব্র নেশার তৃষ্ণা জাগে আমার। নিজেকে আটকাতে পারিনা। আবার তাকে দেখি। রাতভর দেখি। সকালে টলতে টলতে অফিস যাই। অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতিজ্ঞা করি, তাকে আর দেখবো না।
এরপর, কিছুদিন পর, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি। নিজেকে আটকাতে পারি না। আবার তাকে দেখি। আবার নেশায় জড়াই।
এই নেশার খোঁজ পেয়েছিলাম ভার্সিটি জীবনের শেষে। অনিমা তখন আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। আমাদের চার-বছরের সম্পর্কটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো কাঁচের দেয়ালের মতো।
আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা। নিজের ওপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। ভার্সিটি লাইফের শেষে এসে সেমিস্টার ড্রপ দিলাম। সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। সারাদিন ঘরে চুপচাপ থাকি। কি করি, কি খাই, কোনো হুঁশ থাকে না আমার।
আমার নিজের উপর মায়াটা চলে গিয়েছিলো তখন।
এমন কষ্ট ভুলতে সবাই নেশায় ডুবে যায়। তাই আমিও ডুবলাম। অন্য নেশায়।
আমি ব্ল্যাক ম্যাজিকের নেশায় পড়ে গেলাম।
কিভাবে অমন পাগলামি ভর করেছিলো আমার মাথায়, জানি না। অনিমার ওপর ভীষণ রাগ ছিলো। মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে ওর ক্ষতি করবো, খুব বড় ক্ষতি করবো। ইহজাগতিক ক্ষতি খুব কম হয়ে যায় ওর জন্য। আমি ওকে অন্যভুবনের কষ্ট দেবো। এমন কষ্ট দেবো, সারাজীবন যা থেকে সে নিস্তার পাবে না।
সে থেকেই শুরু আমার ঐ ব্ল্যাক ম্যাজিক চর্চা।
কি কি শিখিনি আমি? ভুডু থেকে শামানদের তন্ত্র মন্ত্র, সবই শিখেছিলাম। অনিমাকে ক্ষতি করার খুব সুন্দর একটা পথ পেয়ে গিয়েছিলাম আমি‌। আর সে পথ ধরে হাঁটছিলাম ধীরে ধীরে।
এরপর হঠাৎ, আমি কাজটি ছেড়ে দিলাম। ভালো লাগছিলো না। অনিমা থাকুক ওর জীবন নিয়ে। ও আমায় ছেড়ে ও চলে গেছে, তাতে কি? আমি কি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না? অবশ্যই পারবো।
আমি আবার আমার নিজের জীবনে ফিরে এলাম।
আবার আমার রোজকার কাজ শুরু হলো‌। সারাদিন ক্লাস, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ল্যাব রিপোর্ট লেখা, নইলে সিটির পড়া তৈরি করা। সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছিলাম বলে বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিলাম, ওরা বের হয়ে তখন চাকরিতে ঢুকছে সব এক এক করে‌। আর আমি জুনিয়রদের রুমে রুমে দৌড়ে বেড়াচ্ছি নোটের জন্য।
কি যে রাগ লাগতো আমার নিজের ওপর। গালি দিতাম নিজেকে‌। একটি মেয়ের জন্য শুধু শুধু নিজের সময়গুলো কেন নষ্ট করলাম!
অনিমাকে ভুলে যাচ্ছিলাম পুরোপুরি। তবু শেষ বিকেলে সূর্যের মিষ্টি কমলা আলোয় কাউকে প্রিয়জনের সাথে হাত ধরে হাঁটতে দেখলে ভীষণ খারাপ লাগতো। অথবা জোছনা ভরা রাতে ঘুম না এলে চুপচাপ চেয়ে থাকতাম সিলিংয়ের দিকে, কিসের এক শূন্যতায় মনটা পুড়তে থাকতো শুকনো পাতার মতো।
তারপর, এক বিকেলে খবরটা এলো।
সেদিন সারাদিন বৃষ্টি। শেষ বিকেলে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে, সূর্যটা মেঘের ফাঁক গলে উঁকি দেবার চেষ্টা করছে, এমন এক সময় সুমন আমাকে এসে জানালো, অনিমা মারা গেছে।
আমি তখন রাজুদের রুমে যাচ্ছিলাম পরেরদিনের পরীক্ষার কিছু নোটস নিতে। সুমনের কাছে কথাটা শুনে আমি গেলাম রাজুদের রুমে। নোটগুলো নিলাম। ওদের সাথে বসেই গ্রুপ স্টাডি করলাম। বাসায় ফেরার পথে মায়ের ফরমাস মতো এক বাক্স কাপড় আটকানোর ক্লিপ কিনলাম। রাতে বাবা-মার সাথে বসে খেলাম। শোবার আগে চেলসি বনাম ম্যান সিটির ম্যাচটি দেখলাম। এরপর শুতে গেলাম।
তারপর, হঠাৎ বাঁধভাঙা কান্না আমার দুচোখ বেয়ে বেরিয়ে এলো। আমি নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। যতো দুঃখ চাপা ছিলো বুকের ভেতর, সব যেন কান্না হয়ে বেরোতে লাগলো। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো, আমার সবটুকু নিয়েই কে যেন চুপিচুপি সরে গেছে আমার কাছ থেকে। তাকে আর কোনোদিন পাবো না।
কিছুক্ষণ পর, কান্না একটু থামলো। আমি উঠলাম। চুপচাপ টলতে টলতে গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালালাম। মোমটা আমার হাতে নিয়ে বসলাম আমার ঘরের আয়নার সামনে। তারপর, কামড়ে হাতের এক আঙুল থেকে রক্ত বের করলাম। রক্ত দিয়ে নকশা কাটলাম আয়নার গায়ে।
এরপর, এক মনে চোখ বন্ধ করে সেই মন্ত্রটি আওড়ানো শুরু করলাম। ব্ল্যাডি মেরির মন্ত্র। সাধারণ মানুষ জানে না সে মন্ত্রের কথা। তারা কেবল জানে, তিনবার ব্ল্যাডি মেরি বললেই আয়নায় ব্ল্যাডি মেরিকে দেখা যায়‌। এই মন্ত্র দিয়ে যে আরো কতো কি করা যায়, এসব তারা জানে না। আমি জানতাম।
মন্ত্রটা পড়ে চোখ মেলে তাকালাম। মোমটা নিভে গেছে। আয়নায় কিছু নেই। আবার মোম জ্বালালাম। আবার মন্ত্র পড়লাম। আবার চোখ মেললাম, আবার দেখলাম মোমটা নেভানো। কিছু নেই আয়নায়। আবার মোমটা জ্বালালাম।
কিন্তু এবার, মোমটা জ্বালাতেই তাকে দেখলাম।
তারপর, এতো বছর পরও আমি তাকে দেখি। নেশায় জড়াই। নেশা থেকে বাঁচবার চেষ্টা করি। পারি না। সে আমাকে টানে। আমি বারবার ছুটে যাই তার কাছে।
অনিমার কাছে।

লেখা- সোয়েব বাশার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন