শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩

গল্প: বিসর্জন | মা তুমি কাঁদছ কেন?

“মা তুমি কাঁদছ কেন?”

শাড়ীর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণার সাড়ে পাঁচ বছরী মেয়ে কৌশিনী। ছোট্ট কৌশিনীর এরূপ বড় প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলো না কৃষ্ণা। মুখে যথা সম্ভব হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “চোখে যেন কী গিয়েছে। চোখ জ্বালা করছে।” জবাব শুনে কিছু না বলে বারান্দার দিকে দৌঁড়ে চলে গেল ছোট্ট মেয়েটি। তৎক্ষণাৎ সে ফিরে আসলো, হাতে জলের পট। মায়ের দিকে জলের পটটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “চোখে জল দাও মা।” মেয়ের এমন কান্ড দেখে এবার সত্যিই হেসে ফেলল কৃষ্ণা। কেমন বড় মানুষের মতো কথা বলে মেয়েটি। বাড়ির সবাই এজন্য কৌশিনীকে বুড়ি বলে ডাকে। যদিও নামটি কৃষ্ণা একদমই পছন্দ না।


গল্প: বিসর্জন | মা তুমি কাঁদছ কেন?


শ্রাবণের অবিরাম ধারা ঝরছে। গাছের পাতাগুলো আপন মনে হেলেদুলে স্নান করছে শীতল জলধারায়। মাঝে মাঝে বজ্রপাতের বিকট শব্দ কানকে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তবু চমাকাচ্ছে না কৃষ্ণা। বজ্রনাদ যেন পৌঁছাচ্ছে না তার কান অবধি। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছে সে। চোখের সাদা অংশ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে দু’এক ফোঁটা স্বচ্ছ নোনাজলও গড়িয়ে পড়ছে সেখান থেকে। সে অন্ধকার ঘরে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলা আকাশ পানে। সে কি মেঘ দেখছে নাকি কোনো কিছুর দিকে তাকানো দরকার দেখে তাকিয়ে আছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করল তার স্বামী সুভাস। সে ঘরের বৈদ্যুতিক বাল্বটি জ্বেলে দিলো তারপরে বিছানার উপরে বসে ফোনটি হাতে নিয়ে বলল, “ভাত আন।” কৃষ্ণার দিকে তাকানোর অবসর নেই যেন তার। কৃষ্ণা কিছু না বলে চুপচাপ প্রস্থান করলো। “কী হয়েছে?” এই প্রশ্নটি সুভাস জিজ্ঞেস করবে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা অবশ্য কৃষ্ণার ছিল না।

“কৌশিনী খেয়েছে?”

“হ্যাঁ। ওকে স্নান করিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।”

আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ খেতে লাগলো সুভাস। একসময় কত গল্প করত তারা। একসাথে কত হাসাহাসি করত আজ যেন সেসব ফুড়িয়ে এসেছে। বর্তমানে তাদের সব কথা সাধারণত মেয়েকে ঘিরেই হয়। তাদের ব্যক্তিগত কথার ঝুলি, ঠাকুরমার ঝুলির মতোই বিলুপ্ত আজ। প্রেমের বিয়ে ছিল তাদের, বিয়ের পরে কতকিছু করার প্ল্যান ছিল কৃষ্ণার। অথচ আজ তার প্রধান কাজ হচ্ছে, রান্না করা এবং মেয়ের দেখাশোনা করা। এ বাড়িতে যখন সে বউ হয়ে এসেছিল, তখন বাড়িটি অন্যরকম ছিল। তার স্বামীর অর্থের অভাব থাকলেও ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না। আজ ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের অর্থের অভাব নেই। কিন্তু ভালোবাসার যেন বড্ড অভাব। 

সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষ্ণা। কিন্তু কী যেন ঘটে গেল, প্রেমের প্রলোভনকে সামলাতে পারলো না সে। প্রবল প্রেমের জোয়ার তার ভিতরে পদ্মার ভাঙ্গন ধরালো। সে পদ্মাপাড়ের মানুষের মতো ভিটেমাটি ছেড়ে স্থানান্তরিত হলো সুভাসের বাড়িতে। জীবনের প্রতিটি উত্থান পতনে তারা দু’জন ছিল একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু কোনো পুরুষ মানুষকে সারাজীবন আকর্ষিত করে রাখা কম কথা নয়। সুভাসেরও সেই আকর্ষণ ক্রমে হ্রাস পেয়ে টাকার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকলো। মানুষ যা পেয়ে যায় তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ ধীরে ধীরে হ্রাস পেলেও যতই টাকা পাক তবুও যেন মানুষের টাকার প্রতি আকর্ষণ কমে না। কী অদ্ভূত এই কাগজে তৈরি জিনিসটি!

গভীর রাত পর্যন্ত সুভাস বাড়ির বাইরে থাকে আরেকটু বেশি ইনকামের আশায়, আরেকটু ভালো থাকার আশায়। সে ভুলে যায় বাড়িতে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, কেউ না খেয়ে বসে আছে। কৃষ্ণা অনার্সে ভর্তি হলো। তার পড়ালেখায় যেন কোনো ক্ষতি না হয় এসম্পর্কে সদাসচেতন সুভাস তাকে হোস্টেলে রেখে পড়ালো। মেধাবী ছাত্রী কৃষ্ণাও প্রতি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে থাকলো। অনার্সের মাঝপথে জন্ম নিলো কৌশিনী। সন্তান সংসার সামলে যেটুকু সময় পাওয়া যায়, ঘুমের সময় থেকে সেটুকু সময় বিয়োগ করে ইনভেস্ট করলো পড়ালেখাতে। স্বপ্ন একদিন নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, এছাড়াও নিজের টাকা দিয়ে নিজের নিজের ছোটখাটো ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করার। অনার্স শেষ হলো, মাস্টার্স শেষ হলো; ভালো ফলাফল করলো কৃষ্ণা। কিন্তু ততদিনে সুভাসের সুর পাল্টে ভেসে আসলো, “চাকরি করতে হবে না। মেয়েটাকে মানুষ করায় মন দাও। আমি যা ইনকাম করি তাতেই তো আমাদের ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। তুমি চাকরি করলে মেয়ে ঠিকভাবে মানুষ হবে না।”

সংসার এবং সন্তান সামলে কী চাকরি করা যায় না! মেয়েদের কাজ কি শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া এবং সন্তান লালন-পালন করা! নাকি প্রতিষ্ঠিত মেয়েরা স্বামীর দাসত্ব ঠিক মেনে না দেখে সুভাসের এত ভয়! ভাবে কৃষ্ণা। এখন ঝগড়া বিবাদের সময় যখন সুভাস কৃষ্ণাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে তখন মনে মনে হাসে কৃষ্ণা। আজ সে অসহায়, বাপের বাড়ি ছাড়া যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই দেখে কিছু না ভেবেই সুভাস স্বাচ্ছন্দে বলে ফেলে, বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ যদি সে প্রতিষ্ঠিত হতো, একথায় বলার আগে একশবার ভাবতো সুভাস। কারণ সে তখন অন্যের উপরে নির্ভরশীল থাকতো না, সে থাকতো স্বনির্ভর মানুষ।এছাড়াও দু’জন মিলে ইনকাম করলে সংসারে আরো কত উন্নতি হতো, সন্তানের এবং নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কত সঞ্চয় করা যেত একথাও ভাবে কৃষ্ণা।

আবার সন্তান সম্ভবা হয়েছে কৃষ্ণা। কৌশিনীকে পড়াতে বসেছে সে। এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, “ভালোভাবে পড়। নাহলে রান্নার মেশিন হয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকতে হবে।”

কৌশিনী প্রশ্ন করল, “রান্নার মেশিন কী মা?”

কৃষ্ণা বলল, “দেখিস না, আমি সারাদিন শুধু রান্না করি।”

কৌশিনী বলল, “তবে কী তুমি পড়ালেখা করোনি মা?”

কৃষ্ণা আর কোনো জবাব দিতে পারলো না। মেয়ের সাথে আজকাল সে কথায় পেরে উঠে না। 

আরও গল্প: একটা ডিভোর্সি মেয়ের কষ্ট

মাঝে মাঝে কৃষ্ণা ভাবে, “সন্তানকে মানুষ করার অর্থ কী? পড়ালেখা শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা? নাকি অন্য কিছু? কৌশিনীর স্বামী যদি ওকে চাকরি করতে না দেয়, সারাজীবন যদি ওকে ঘরের কাজ করতে হয়, তাহলে পড়ালেখা শিখিয়ে কী হবে! নানা রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে কী হবে! একদিন তো রান্না ঘরের ঘামে সেই স্বপ্নগুলোকে বিসর্জনই দিতে হবে।”

গল্পের নাম: বিসর্জন
লেখক: অংকুর রায় অনিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন