রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গল্প: অনুবোধের অনুরনন

বয়স প্রায় ষাট বছর ছুইঁ ছুইঁ রিকশাওয়ালাটি আমার হাতে বাড়তি পাঁচ টাকা ফিরিয়ে দিতেই আমি তব্দা খেয়ে গেলাম।

ভাবছি এই লোকটার মাথা ঠিক আছে তো? যেখানে মানুষ কিছু পেলে ছাড়ে না আর উনি তো সকাল সন্ধ্যা খেটে খাওয়া একজন রিকশাওয়ালা। 

এদের স্বভাব হলো অসহায় পেলেই পাঁচ টাকার স্থানে পচিশ টাকা দাবী করে বসা। আর টাকা দিতে আপত্তি করলে ওরা গলার স্বর উঁচু করে এমন ভাবে কথা বলতে শুরু করে। আমাদের পাঁচজনের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এর থেকে মুক্ত থাকার জন্যে আমি কখনো পথে ঘাটে দেরি হলে নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বাড়তি কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিই।

আজ যা হলো, আমি আর বর বাইরে থেকে বাসায় ফিরছি। তখন পথে রিকশা থামিয়ে হোটেল থেকে বাচ্চাদের জন্য নাস্তা নেওয়া হলো। বাসার নিচে রিকশা থেকে নেমে বর চলে গেলো বাসার নিচে লিফটটা ধরার জন্যে। আমি তার নির্ধারিত ভাড়ার সাথে আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, চাচা পথে দেরি হলো সামান্য তাই এই বাড়তি পাঁচ টাকা। 

সে পাঁচ টাকার নোটটি তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে চনচন গলায়,

ধরেন ধরেন, আমি এমন টাকা নেই না কোন যাত্রীর কাছ থেকে। 

নিলে সমস্যা কি?

বলল, এই এট্টুক সময়টাতো আমার নিজের কারো জন্যেও লাগতে পারতো। তাইনা ?তখন কি আমি তাদের থেকে নিতাম? 

আমি বললাম, চাচা সেটা ভিন্নকথা। তারা আপনার আপনজন। কেন নিবেন? আপনার সময়ের মূল্য আছে। আপনারতো সময় গিয়েছে। এখন এটা রাখেন।

বলল, না না আপনি নেন। গ্যাছে তো কি হইছে? ছোট্ট একখান দেশ আমগো। বিছরাইলে দেখা যাইবে সবাই সবাইর কুটুম হই পাতালতার উপর দিয়া হইলেও। 

বললাম। এভাবে যদি সবার থেকে বাড়তি টাকা না নেন তাহলেতো আপনার সংসারে অভাব পড়বে চাচা।

গলার স্বর টেনে টেনে বললেন, নায়ায়ায়া...মা, আমি গরিব নই। আমার গ্রামে জমিজিরাত আছে। বড় ব্যাটা ছাওয়াল সেখানে আছে। গোয়াল ভরা গরু আছে। রিকশা চালাই এখন অভ্যাসের চাপে। মন লয়তো ছয়মাস চালাই ঢাকা আইসা। আবার মন লয়তো ছয়মাস আমার পরিবারের কাছে থাকি। পুরানা খাসলত। তাই আমি ছাড়তে পারিনা। আগে ম্যালা অভাব অনটনে ছিলাম রে মা। তাই রিকশা চালাইছি। 

বুঝলাম পথচলায় কারণে অকারণে ছোটলোক বিশেষণে বিশেষায়িত  হওয়া কিছু কিছু রিকশাওয়ালার কাছ থেকেও শেখার অনেক কিছুই আছে।

আর কিছু মানুষ কাড়ি কাড়ি থেকেও আরো চাই আরো চাই। আর ইনি সৎ পরিশ্রমে কত অল্পতেই একজন সুখী মানুষ। 

হৃদ্যতাপূর্ণ রিকশাওয়ালাটি রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়েই চলে যেতে লাগলেন আর আমি মুগ্ধ চোখে তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম।


লেখিকা: রেহানা পুতুল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন